“চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত” কি ? (The Permanent Settlement Act of 1793)
ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (Land Revenue System in Bengal – The Permanent Settlement)
হেস্ট্রিংস প্রবর্তিত রাজস্ব ব্যবস্থার ত্রুটি:-
কোম্পানির ভূমি রাজস্ব আদায়ের জন্য গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্ট্রিংস ২টি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন –
- ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ‘পাঁচসালা বন্দোবস্ত’
- ১৭৭৭ ক্রিস্টাব্দে ‘একসালা বন্দোবস্ত’
কিন্তু ২টি ব্যবস্থায় জমি থাকে বাৎসরিক আয়ের কোন নিশ্চয়তা ছিল না । কারণ প্রতি বছর ইজারাদার পরিবর্তন হতো, ফলে জমির ম্যান উন্নত হতো না । উপরন্তু ইজারাদাররা কম সময়ে বেশি লাভের জন্য প্রজাদের উপর অত্যাচার চালাতো । এই অসুবিধার কারণে একটি নতুন ও সুসংগঠিত রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন জরুরি হয়ে পরে ।
শোর – গ্রান্ট বিতর্ক:-
১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিস ভারতে আসেন ও বাংলায় ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন । এক্ষেত্রে একটি বিতর্ক উপস্থিত হয় ।
- রাজস্ব বিভাগের প্রধান জন শোর – মোগল আমলে জমিদারিই ছিল জমির মালিক, তাদের সাথে জমির বন্দোবস্ত করা উচিত । তার মতে জমির জরিপ না করে জমিদারদের সাথে বন্দোবস্ত করলে কোম্পানির ক্ষতি হবে । তিনি স্থায়ী বন্দোবস্তের পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদী বন্দোবস্তের পক্ষে মত দেন ।
- দলিল বিভাগের প্রধান জেমস গ্রান্ট – মোগল আমলে জমির প্রকৃত মালিক ছিল সরকার, জমিদার ছিল কেবল মাত্র রাজস্ব সংগ্রাহক ।
দশসালা বন্দোবস্ত:-
লর্ড কর্নওয়ালিস ইংল্যান্ডের অনুকরণে ভারতেও জমিদারদের জমির মালিকানা দেওয়ার পক্ষে ছিলেন । বহু আলোচনার পর ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দের ১০ই ফেব্রুয়ারী জমিদারদের সাথে দশ বছরের জন্য জমির বন্দোবস্ত করেন । এই ব্যবস্থা ‘দশসালা বন্দোবস্ত’ নামে পরিচিত ।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত:-
ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পিট, বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি হেনরি ডান্ডার্স, রাজস্ব বোর্ডের সদস্য স্যার জন শোর ও চার্লস গ্রান্ট ও অন্যান্য সদস্যদের অনুমতি পাওয়ার পর, লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২২শে মার্চ ‘দশসালা বন্দোবস্ত’ -কে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ -তে পরিণত করেন ।
বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় এই ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় । পরবর্তীকালে বারাণসী, উত্তর -পশ্চিম প্রদেশ ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির কিছু কিছু স্থানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয় ।
এই ব্যবস্থা অনুসারে –
- জমিদার ও তালুকদাররা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরকারকে রাজস্ব প্রদান করে বংশানুক্রমে জমি ভোগ করতে পারবে ।
- নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রাজস্ব প্রদান না করতে পারলে সমগ্র জমিদারি বা কিছু অংশ বিক্রি করে রাজস্ব মেটা হবে ।
- খরা, বন্যা, মহামারী বা অন্য কোনো পি;রাকৃতিক বিপর্যয়েও রাজস্ব মুকূপ হবে না ।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের উদ্দেশ্য:-
- নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট হরে রাজস্ব আদায় ।
- এই ব্যবস্থার মাধ্যমে এক নতুন রাজকীয় সম্প্রদায় গড়ে তোলা যারা তাদের সমর্থন করবে ।
- জমিতে স্থায়ী শর্ত পলে জমিদাররা কৃষির উন্নতি করবে । এতে দেশ সমৃদ্ধিশালী হবে ও কোম্পানির লাভ হবে ।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর সুফল:-
- জমিদারদের অবস্থার উন্নতি হয়
- সরকারে রাজস্ব বৃদ্ধি পায়
- সরকারের অনুগত এক জমিদার শ্রেণীর সৃষ্টি হয়
- খাজনা সুনির্দিষ্ট হওয়ায় কৃষকদের সুবিধা হয়
- জমির স্বত্ব সুনির্দিষ্ট হওয়ায় তারা জমির উন্নতিতে সচেষ্ট হন
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর ত্রুটি:-
- নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খাজনা না দিতে পারার জন্য অনেকে জমিদারি হারায়
- রাজস্ব নির্দিষ্ট থাকায় সরকারের লোকসান হয় কারণ জমির বৃদ্ধি বা জমিদারদের আয় বৃদ্ধি পেলেও সরকারের রাজস্ব একই থাকে ।
- বেশি খাজনার জন্য জমিদাররা প্রজাদের উপর অত্যাচার চালায়
- এক্ষত্রে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার কোনো বন্দোবস্ত হয়নি
- কিছু ক্ষেত্রে জমিদাররা শহরে বাস করত । এই অনুপস্থিত জমিদারদের সাথে কৃষকদের কোন সম্পর্ক না থাকায় প্রজাদের দুর্দশা শুরু হয়
- পত্তনি প্রথা – কোন কোন জমিদার দ্রুত খাজনা আদায়ের জন্য জমিদারিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে অন্যান মধ্যস্বত্বভোগীদের পত্তনি দেন ।এই পত্তনিদারদের বলা হত সদর পত্তনি । এরা আবার অনুরূপ ভাবে অন্যদের পত্তনি দেন । এদের দর পত্তনিদার বলা হয় । এর পরের স্তর হল দর-দর-পত্তনিদার । এই ভাবে ৫ থাকে ৬ টি স্তরের আবির্ভাব হয় । তাদের উদ্দেশ্য ছিল যত বাসি পরিমানে রাজস্ব আদায় করা । ফলে প্রজাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পরে ।